আবহাওয়া ও জীবন যাপনে পরিবর্তনের কারণে স্থূলতা বাড়ছে দিন দিন। আগে মধ্যবয়সীদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেলেও বর্তমান সময়ে শিশুদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর মূল কারণ অতিমাত্রায় জাঙ্ক ফুড নির্ভরতা এবং শুয়ে বসে অলস সময় কাটানো। শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমা হলে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়।

দৈহিক স্থূলতার কারণে শরীরে যেসব মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম।

ওবেসিটি হল শরীরের এমন একটি অবস্থান যে অবস্থায় শরীরে স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়। হিপোক্রেটিস বলেছেন স্থূলতা অবশ্যম্ভাবীভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দুর্যোগপূর্ণ পরিণতি বয়ে আনে। এ অবস্থায় শরীরে অতিরিক্ত স্নেহ বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হয় এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে, ফলে আয়ু কমে যেতে পারে এবং একই সঙ্গে শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বডি মাস ইনডেক্স (বিএমাই) হল শরীরের উচ্চতা ও ওজনের আনুপাতিক হার, যা দিয়ে বোঝা যায় যে কোনো ব্যক্তি মাত্রাধিক ওজন (মরবিড ওবেসিটি) বিশিষ্ট কিনা। যদি কারও বডি মাস ইনডেক্স ২৫ কেজি/মি২ থেকে ৩০ কেজি/মি২ এর মধ্যে থাকে তখন তাকে স্থূলকায় বা মোটা বলা যেতে পারে, আর যখন বডি মাস ইনডেক্স ৩০ কেজি/মি২ বেশি থাকে তখন তাকে অতি স্থূলকায় বা অতিরিক্ত মোটা বলা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসাব মতে ২০১৬ সালে ১৯৭৫ সালের চেয়ে ৩ গুণ দৈহিক স্থূলতা রোগী ছিল। এ সময় ১৮ বছরের বেশি বয়সী ১.৯ বিলিয়ন (৩৯ শতাংশ) মানুষ দৈহিক স্থূলতায় আক্রান্ত ছিল। এর মধ্যে ৬৫০ বিলিয়ন ছিল ওবেস (১৩ শতাংশ)। ৫ বছরের কম বয়সী ৪১ বিলিয়ন শিশু ও এই সময়ে দৈহিক স্থূলতায় আক্রান্ত ছিল। ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৪০ মিলিয়ন শিশু-কিশোর স্থূল দেহী ছিল।

বডি মাস ইনডেক্স-ই এর সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং আরও মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখা গেছে, কোমর-নিতম্বের অনুপাত মেনেই এই চর্বি বা স্নেহ পদার্থ সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকে এবং এর ফলে হৃদ-ধমনীর রোগ দেখা দিতে পারে। বডি মাস ইনডেক্স শরীরের স্নেহ পদার্থের শতকরা হার ও শরীরের মোট স্নেহ পদার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

মৃত্যুহার

স্থূলতা এমন একটা রোগ, যাকে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে খাড়া করা যেতে পারে, তবে একে ঠেকানোও যেতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেকেই সমীক্ষা করে দেখেছেন যে, বডি মাস ইনডেক্স যাদের ১৮.৫, ২২.৯ কেজি/মি২ এবং ধূমপায়ী নন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কম এবং যে ধূমপায়ীদের বডি মাস ইনডেক্স ২৩.০ থেকে ২৬.৯ শম/স২ তাদের ধীরে ধীরে এই ঝুঁকির মাত্রা বাড়ে। বিশেষ করে ষোলো বছরের বেশি বয়স, ঋতুচক্র হয়ে গেছে এমন মেয়েদের বিএমআই ৩২-র বেশি হলে, তাদের মৃত্যুহার অন্যদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।

অসুস্থতা

স্থূলতার কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা থাকে। মূল সমস্যার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়, যেমন মেটাবলিক সিনড্রোম বা কার্ডিওভাসকুলার রোগ ও মধুমেহ বা ডায়াবেটিস রোগ, উচ্চরক্তচাপ, রক্তে বেশি কোলেস্টরল ও উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

দৈহিক স্থূলতার কারণ

* পরিমাণে বেশি বা বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ

* শ্রমবিমুখ বা কম পরিশ্রম করা

* জীনগত

জনস্বাস্থ্য

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার অনুমান অতিওজন ও স্থূলতা খুব শিগগিরই হয়তো কমপুষ্টি (আন্ডার নিউট্রিশন) ও সংক্রামক ব্যাধির (খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য যা সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ) মতো প্রথাগত জনস্বাস্থ্য সমস্যার জায়গা নেবে। তার বিস্তার, খরচ ও স্বাস্থ্যে তার প্রভাবের কারণেই স্থূলতা হল একটা জনস্বাস্থ্য ও নীতি সম্পর্কিত সমস্যা।

শিশু বয়সের স্থূলতা

শিশুর বয়স ও লিঙ্গের সঙ্গে সুস্থ বডি মাস ইন্ডেক্স (বিএমআই) ক্রমবিন্যাস ওঠানামা করে। বিএমআইর ৯৫তম পার্সেন্টাইলের শিশুদের ও বয়ঃসন্ধিকালের স্থূলতার সংজ্ঞা ঠিক করা হয়। এ পার্সেন্টাইলগুলোর ভিত্তি হল ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪-এর মধ্যবর্তী সময় এবং স্থূলতার হারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধির দ্বারা তা প্রভাবিত হয় না। একবিংশ শতাব্দীতে শিশু বয়সের স্থূলতা মহামারীর আকার নিয়েছে, উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব উভয় জায়গাতেই এ হার বেড়েছে। কানাডার কিশোরদের মধ্যে স্থূলতার হার ১৯৮০-এর দশকে ১১% থেকে ১৯৯০-এর দশকে ৩০%-এর ওপর বেড়ে গেছে। এই একই সময়কালে ব্রাজিলের শিশুদের মধ্যে এই হার ৪ থেকে বেড়ে ১৪% হয়েছে।

প্রাপ্তবয়স্কদের স্থূলতার পাশাপাশি শিশু বয়সের স্থূলতার হার বাড়ার সঙ্গে বহু বিষয় জড়িয়ে আছে। সাধারণ খাদ্য বদল ও শারীরিক কসরত কমে যাওয়াকেই সাম্প্রতিককালে এই হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে দুটি মূল কারণ বলে মনে করা হয়। কারণ শিশু বয়সের স্থূলতা বড় বয়সেও প্রায়ই থেকে যায় অসংখ্য কঠিন ব্যাধিকে সঙ্গী করে। যেসব শিশু ভীষণ মোটা প্রায়ই তাদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে এদের হাইপারটেনশন (উচ্চরক্তচাপ), ডায়াবেটিস (মধুমেহ), হাইপারলিপিডেমিয়া ও চর্বিযুক্ত লিভার থাকে। এসব শিশুদের চিকিৎসা হল প্রাথমিকভাবে লাইফস্টাইল বা জীবনধারণের ধরনে হস্তক্ষেপ ও আচার-আচরণ প্রণালি পরিবর্তন।

 

কলমকথা/ বিথী